আইনি নোটিসের উত্তরে পাল্টা নোটিস। বিবৃতির উত্তরে পাল্টা বিবৃতি। হৃতিক রোশন এবং কঙ্গনা রানাউতের বিবাদ ফিল্মি গসিপের গণ্ডি ছাড়িয়ে ক্রমশ সম্মুখসমরের চেহারা নিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার খেউড় আর নয়, ব্যক্তিগত ভাবে মিডিয়ার কাছে মুখ খোলাও আর নয়। একেবারে আইনি লড়াই। হৃতিক যদি তাঁর প্রচারসচিবকে দিয়ে বিবৃতি দিয়ে থাকেন, তার উত্তরে কঙ্গনার হয়ে ব্যাট ধরেছেন তাঁর আইনজীবী। হৃতিক যদি প্রকারান্তরে কঙ্গনার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকেন, কঙ্গনা সরাসরি হৃতিককে মিথ্যাবাদী বলে তোপ দাগছেন। তার মাঝখানে আবার উঁকি দিচ্ছে সাইবার অপরাধের গন্ধ!বলিউডের দ্বন্দ্বসমাসও বদলে গেল তবে। ফিল্মি পার্টিতে ঝগড়া-ঝামেলা, ফিল্মের সেটে বিবাদ এবং সর্বোপরি প্রেম-ভালবাসা নিয়ে তীব্র মন কষাকষি নতুন কিছু নয়। মামলা-মোকদ্দমা হয়নি এমনও নয়। কিন্তু প্রথম সারির দুই তারকা ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে লাগাতার পরস্পরের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন এবং লিখিত বিবৃতি দিয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ অভিযোগ আনছেন, এটা বড় একটা দেখা যেত না।
হৃতিক-কঙ্গনা সেটাই করে দেখালেন। ‘কৃষ থ্রি’ থেকে ‘আশিকি থ্রি’ আসতেই যাবতীয় ‘আশিকি’ একেবারে ‘কাট্টি বাট্টি’ হয়ে গেল!
হৃতিক প্রথমে মানহানির নোটিস পাঠালেন। কঙ্গনা হৃতিকের বিরুদ্ধে তাঁর ই-মেল হ্যাক করার অভিযোগ আনলেন। হৃতিক আবার বিবৃতি দিয়ে দাবি করলেন, তাঁর নামে যে আইডি (hroshan@email.com) থেকে হ্যাক করার অভিযোগ উঠেছে, সেটি একটি ভুয়ো আইডি। অন্য কেউ তাঁর নাম করে এই আইডি ব্যবহার করছিল। হৃতিক এও বলেছেন, দু’বছর আগেই তিনি ওই ভুয়ো আইডি নিয়ে সাইবার অপরাধ শাখায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। এই সব প্রসঙ্গ তোলার জন্য নাম না করে কঙ্গনাকে মানসিক রোগী বলতেও কসুর করেননি হৃতিক। জবাবে কঙ্গনার আইনজীবী নাম করেই হৃতিককে মিথ্যুক বলে দাবি করেছেন।
এত দাবি-পাল্টা দাবির পিছনে মূল বিষয়টা কী? দু’জনের নষ্ট সম্পর্ক। নষ্ট হয়েও যার রেশ ফুরোচ্ছে না। কারণ, হৃতিক দাবি করছেন কঙ্গনার সঙ্গে তাঁর কোনও রকম সম্পর্ক ছিল না। কঙ্গনাই নাকি মানসিক অসুস্থতায় নানা রকম কল্পনা করতেন। অজস্র মেল পাঠাতেন। আর এখানেই হৃতিকের প্রতি মিথ্যাবাদিতার অভিযোগ কঙ্গনার। তাঁর বিব়ৃতির এটাই মূল কথা। কঙ্গনার আইনজীবী দাবি করছেন, হৃতিক আর কঙ্গনার ঘনিষ্ঠতা নিয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণের কোনও অভাব নেই। হৃতিক বেমালুম মিথ্যা বলছেন, দাবি তাঁদের।
ব্যক্তিগত ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা নিয়ে খুল্লম খু্ল্লা কথা বলার ধারাটা হালে দেখা যাচ্ছে বলিউডে। ফেসবুক-টুইটার-ইনস্টাগ্রাম যুগে তারকাদের জীবন এখন অনেক উন্মুক্ত। রণবীর কপূরের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার পরে তাঁর দুই প্রাক্তনী দীপিকা পাড়ুকোন আর সোনম কপূর টিভি শো-এ প্রকাশ্য হাসিমস্করায় মেতেছিলেন। প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার বিরুদ্ধে টুইটারে ক্ষোভ উগরেছিলেন কর্ণ জোহর। কিন্তু সলমন খান আর শাহরুখের ঝামেলার ঘটনাটা এর পাশে রাখলেই তফাৎটা স্পষ্ট হয়। ক্যাটরিনার পার্টিতে দু’জনের বচসা গোপন থাকেনি ঠিকই। কিন্তু তা নিয়ে দু’জনের কেউই মিডিয়াতে একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেননি। আইনি নোটিসও পাঠাননি। অতীতে প্রেম চোপড়ার বিয়ের অনুষ্ঠানে রাজ কপূর-রাজকুমারের ঝগড়া বা স্টুডিও-চত্বরে সঞ্জীবকুমারকে নূতনের ‘চড় মারা’ নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছিল। কিন্তু প্রকাশ্য বিবৃতি? না, কেউই সে পথে হাঁটেননি।
তুলনায় সলমন-ঐশ্বর্যার ঝগড়া ছিল অনেক বেশি খোলাখুলি। ২০০৩ সালে সঞ্জয় লীলা বনশালীর একটি ছবিতে তাঁরা একসঙ্গে কাজ করবেন বলে খবর রটার পরে মুখ খোলেন অ্যাশ। দাবি করেন, ‘‘সলমনের অনেক ধরনের দুর্ব্যবহার, মাদকাসক্তি, অত্যাচার আমায় সইতে হয়েছে। নিজের ও পরিবারের সুস্থতা ও মর্যাদার স্বার্থেই আর সলমনের সঙ্গে কাজ করতে পারব না।’’ পরে একই ভাবে সলমন তাঁকে হুমকি দিয়েছেন বলে একেবারে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে অভিযোগ করেছিলেন অ্যাশের তৎকালীন প্রেমিক বিবেক ওবেরয়।
হৃতিক-কঙ্গনার বেলায় প্রথমে হৃতিক আশিকি-থ্রি থেকে কঙ্গনাকে বাদ দেওয়ার জন্য কলকাঠি নাড়ছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। জানুয়ারির শেষাশেষি একটি সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গেই কঙ্গনা বলেছিলেন, প্রাক্তন প্রেমিকরা মাঝেমধ্যে বোকা বোকা কাজ করে নজর কাড়ার চেষ্টা করে থাকেন! হৃতিকের নাম না করলেও ইঙ্গিতটা ছিল স্পষ্ট। সেটাকে আরও স্পষ্ট করে দিয়ে হৃতিকই তখন টুইট করেন, ‘মিডিয়ায় যাদের নাম দেখি, সেই সব মেয়েদের (নির্ঘাত তাঁরা দারুণ) বদলে পোপের সঙ্গে রোম্যান্স করাটা বেশি স্বাভাবিক আমার পক্ষে।’
বাদানুবাদ এখানেই শেষ হতে পারত। হয়নি। গত মাসে কঙ্গনাকে ক্ষমা চাইতে হবে বলে দাবি করে হৃতিকের আইনজীবী নোটিস দেন। তাতে বলা হয়, প্রচারের লোভে কঙ্গনা তাঁদের দু’জনের প্রেমের ‘ভুয়ো গল্প’ ফাঁদছেন। আইনজীবীর দাবি, ‘হৃতিক-কঙ্গনার মধ্যে দু’টি ছবিতে একসঙ্গে অভিনয়ের পেশাদারি সম্পর্কটুকুই সার। আর কোনও সামাজিক, আত্মিক, ব্যক্তিগত বা অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতার গল্প এখানে নেই।’ এর পরেই উকিল মারফত ২১ পাতার জবাবি চিঠি দেন ‘কুইন’-এর নায়িকা। তাতেও না থেমে এ বার হৃতিক লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন। কঙ্গনাও তার উত্তর পাঠিয়েছেন। হৃতিক তাঁর আইনি নোটিস ফিরিয়ে না-নিলে ফৌজদারি মামলা করার হুমকি দিয়েছেন।
এ সবের নিট ফল? বলিউডের ট্রেড অ্যানালিস্ট বিকাশ মোহনের মতে, ‘‘ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে এখন মানুষ ঢের সম্মানের চোখে দেখে। মিডিয়ার পাঁচ কান না-করে পরিণত ভঙ্গিতে বিষয়টা মিটিয়ে ফেললেই ভাল ছিল।’’ আর এক ট্রেড অ্যানালিস্ট আমোদ মেহরার আক্ষেপ, ‘‘একজন বড় হিরো এ সব আইনি নোটিস দিলে তা এক ধরনের ক্ষমতার আস্ফালন হয়ে ওঠে। হৃতিকের স্টার ইমেজ ধাক্কা খাবে।’’
আইনি লড়াইয়ের এই আবহই মনে পড়াচ্ছে পঞ্চাশের দশকের কথা। দিলীপ কুমারের সঙ্গে মধুবালার সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে বাতাস তখন বেশ ভারী। ‘নয়া দৌর’ ছবি থেকে মেয়ে বাদ পড়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে নোটিস পাঠালেন মধুবালার বাবা। আদালতে এসে দাঁড়িয়েছিলেন দিলীপকুমার। মধুবালার তরফে অভিযোগ ছিল, একটি আউটডোরে যেতে চাননি বলে তাঁকে বাদ দিয়ে বৈজয়ন্তীমালাকে নেওয়া হয়েছে। দিলীপকুমার কিন্তু পরিচালক বি আর চোপড়ার পক্ষই নেন। বৈজয়ন্তীমালার কাস্টিং বহাল থাকে। কিন্তু দিলীপ আদালতে দাঁড়িয়ে স্বীকার করে নেন, মধুবালার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথাও। তাঁদের ভাঙা মন নিয়েই শেষ হয় মুঘল-ই-আজমের বাকি শ্যুটিং!
হৃতিক-কঙ্গনার ছেঁড়া ঘুড়ি তেমন কোনও কাহিনির জন্ম দিল না।

Post a Comment