
মুসলিম স্থাপত্যরীতির অনুসরণে মিনার কিংবা খ্রিস্টানদের গীর্জা এসবই ছিল একসময়ের উচ্চতম স্থাপনা। তারপর এলো আইফেল টাওয়ারের যুগ। ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের উচ্চতা সবাইকে চমকে দিল। বেতার সম্প্রচার যুগ শুরু হলে সম্প্রচার সংস্থাগুলো উঁচু উঁচু টাওয়ার বানিয়ে এন্টেনা বসাতে শুরু করে।
কিন্তু এসবের কিছুই মানুষের বসবাসের জন্য তৈরি হয়নি। নিউইয়র্ক বা শিকাগোর মত জায়গায় বেশি সংখ্যক মানুষেকে বসবাস ও কাজের সুযোগ করে দিতে ভবনগুলো ওপরের দিকে উঠতে থাকে। কিন্তু এখানে প্রযুক্তিগত একটি সীমাবদ্ধতা ছিল।

সহজ করে বলি
ধরুন আপনি একজন শক্ত-সমর্থ মানুষ, আপনার ঘাড়ের ওপর আরেকজনকে দাঁড়াতে দিলেন। এভাবে ক’জন দাঁড়াতে পারবে আপনার ওপর? একজন, দু’জন? তার বেশি কি পারবে? তখন নিচের দিকটায় ওজন ভাগ করে নিতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে দাঁড়াতে হবে। এই মানব পিরামিডের উচ্চতা যত বাড়বে, নিচের দিকের বিস্তৃতিও তত বাড়বে। মিশরের পিরামিড এভাবেই তৈরি হয়েছে। কিন্তু উঁচু ভবন বানাতে গিয়ে যদি নিচের জায়গা নষ্ট করতে হয় তকে উঁচু ভবন বানিয়ে লাভ কি?
বিষয়টাকে আরও সহজ করে বলা যায়। উঁচু ভবন মানে তার ওজনটাও বেশি। এ ওজনটা নিতে হবে নিচের তলাগুলোকেই। কাজেই মজবুত হতে হবে সেগুলোকে, কংক্রিটের পুরুত্ব বাড়াতে হবে। এভাবে উচ্চতা বাড়াতে বাড়াতে এক পর্যায়ে দেখা যাবে নিচের তলার পুরো জায়গাই পুরু দেয়ালের দখলে চলে গেছে। নিচের দিকের তলাগুলো যদি দেয়ালের দখলেই চলে যায় তবে ভবনের উচ্চতা বাড়িয়ে কি লাভ? ভবনের উচ্চতার একটা সীমা তৈরি হয়েছিল এভাবেই।
এ অবস্থায় দীর্ঘ ধাতব দন্ড বা বীম তৈরির প্রযুক্তি মানুষের আয়ত্তে চলে আসে। ইট-কংক্রিটের কাঠামোর বদলে ধাতব দন্ড বা বীমের কাঠামো তৈরি শুরু হয়। এটি ছিল কংক্রিটের চেয়ে মজবুত এবং হালকা। আরও পরে আসে স্টীলের বীম, যা আরও মজবুত এবং হালকা। অনেক বেশি ভার বহনে সক্ষম ছিল এগুলো। এসব ভবনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভবনটিকে দাঁড় করিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বাইরের দেয়ালের কোন ভূমিকা ছিল না। ফলে আলো-বাতাস চলাচলের সুযোগ রেখে আরও বেশি খোলামেলা ভবন তৈরি করা সম্ভব হল।
সমস্যা অবশ্য আরও ছিল। এত উঁচু ভবনে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। প্রায় একই সময়ে লিফটের প্রযুক্তিও চলে আসে যা গগনচুম্বী ইমারত নির্মাণকে বস্তবসম্মত করে তোলে। এছাড়া রয়েছে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছুঁড়ে দেবার কারণে নিভে যায়।
বাতাসে দলুনি
উঁচু গাছ যেমন বাতাসে দোল খায়, গগনচুম্বী ইমারতও তেমন বাতাসে কিছুটা দোল খায়। সেভাবেই তৈরি হয় ভনগুলো। কাঠামোর কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু এ দুলুনির পরিমাণ বেশি হলে ভবনের ওপরের দিকের তলাগুলোয় কেউ থাকতে চাইবে না, ভেতরের আসবাববপত্র এদিক ওদিক কাত হয়ে পড়বে। দুলুনি কমাতে আনুভূমিক বীমগুলোকের উলম্ব কলামগুলোর সাথে অত্যন্ত মজবুত করে লাগানো হয়। আর ভবনের কেন্দ্রে যেখানে লিফটগুলো থাকে সেখানটা স্টীলের ট্রাসের সাহায্যে আরও মজবুত করা হয়। ষাটের দশক থেকে টিউব স্ট্রাকচার পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হলে আরও ওপরে উঠতে থাকে গগনচুম্বী ইমারতগুলো।
উচ্চতম ভবন নির্মাণের কারণ
অবশ্য অল্প জায়গায় বেশি মানুষকে কাজ করতে দেয়ার সুযোগ করে দেয়াই শুধু নয়, অনেক ক্ষেত্রে এটি আবেগ ও জাতীয় গর্বের বিষয়ে পরিণত হয়। উচ্চতম ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা তাই চলছেই। কতটা ওপর পর্যন্ত উঠতে পারবে মানুষ? অনেকে বলছেন বর্তমান প্রযুক্তিতে এক মাইল উঁচু ভবনও তৈরি করা সম্ভব। আবার অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন প্রযুক্তি কোন সমস্যা নয়, টাকাটাই সমস্যা। ‘বুর্জ খলিফা’ তৈরির সময় অত ওপরে কংক্রিট পাম্প করার সমস্যাটার সমাধান হয়েছিল।
উচ্চতম ভবনগুলো
গগনচুম্বী ইমারত নির্মাণ শুরুর পর শীর্ষ ভবনগুলো প্রধানত তৈরি হয়েছিল নিউইয়র্কে। প্রায় ৮৭ বছর ধরে রাজত্ব ধরে রেখছিল শহরটি। তারপর প্রায় ৩০ বছর রাজত্ব করেছে শিকাগো। সব মিলয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩০ বছরের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে পূর্ব গোলার্ধ বা প্রাচ্যের দেশগুলো রেকর্ড সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় নেমেছে এখন।
পৃথিবীর প্রথম গগনচুম্বী ইমারত কোনটি তা নিয়ে ভিন্নমত আছে। ১৮৭০ সালে নিউইয়র্কে ১৪২ ফুট উঁচু আটতলা একটি ভবন তৈরি হয়। নাম ছিল ইক্যুয়িটেবল লাইফ বিল্ডিং। মানুষের ওঠানামার জন্য লিফটও ছিল এতে। গীর্জা নয় এমন ভবনগুলোর মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে উঁচু।

১৮৮৪ সালে শিকাগোয় নির্মিত হোম ইন্স্যুরেন্স ভবনটি ছিল ১৩৪ ফুট উঁচু। সাততলা এ ভবনটিতে প্রথমবারের মত ধাতব ফ্রেম ব্যবহার করা হয়। এটিকেই প্রথম গগনচুম্বী ইমারত বলেন অনেকে। পরে আরও দুই তলা যোগ করা হয় ভনটির ওপরে, উচ্চতা দাঁড়ায় ১৮০ ফুট। এটি অবশ্য ভেঙে ফেলা হয়েছিল ১৯৩১ সালে।
১৯০১ সালে গগনচুম্বী ইমারতের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হয়। ফিলাডেলফিয়া সিটি হলের কাজ শেষ হয় এ বছর। এটি ছিল ৫১১ ফুট উঁচু। গীর্জার রাজত্বের অবসান ঘটালেও ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারকে অতিক্রম করতে পারেনি এটি।

গগনচুম্বী ইমারত এশিয়াতে
১৯৭৪ এ সিয়ার্স টাওয়ার নিমার্ণের পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত কোনো বড় ভবনের দেখা পায়নি বিশ্ব। এরপরের ইতিহাস কিন্তু এশিয়ার। ১৯৯৭ মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে তৈরী হলো পেট্রোনাস টাওয়ার। এটি ছিল ১৪৮৩ ফুট উঁচু। যদিও ভবনটি ছিল মাত্র ৮৮ তলার। এর কারণ হলো ভবনের উপরে ছিল বিশাল উচুঁ এন্টেনা। যাই হোক এরপর এলো তাইপে ১০১। ২০০৪ এ তাইপে এ তৈরী এ ভবনের উচ্চতা হলো ১৬৭১ ফুট। "তাইপে ১০১" এর নাম থেকেই বোঝা যা্য় এখানে তলা আছে ১০১ টি। মধ্যখানে ২০০৮ এ ১০১ তলা সাংহাই ওয়ার্ল্ড ফাইন্যান্সিয়াল সেন্টার চালু হলো বটে, কিন্তু এটির এন্টেনার উচ্চতা কম থাকায় এটি তাইপে ১০১ এর নিচুই (১৬১৫ ফুট) রয়ে যায়। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে যায় বুর্জ খলিফা। ততদিনে ব্যবসা বানিজ্যের কেন্দ্র হয়ে দাড়িয়েছে দুবাই। দুবাই এ ২০০৪ এ (যে বছর তাইপে ১০১ ভবনটি চালু হয়) ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ২০০৯ এ। উদ্বোধন হয় ২০১০ এর ৪ই জানুয়ারিতে। এটি সত্যিকার অর্থেই অন্য সব ভবনের চেয়ে অনেক অনেক উচুঁ। এটি উচ্চ্তা ২৭১৭ ফুট। আর এতে রয়েছে ১৬২ টি তলা।

ভবনের উচ্চতা নির্ণয়
কিসের ভিত্তিতে উচ্চতম ভবনের উচ্চতা নির্ণয় করা হবে? ভবনের সর্বোচ্চ বিন্দুর উচ্চতার নিরিখেই উচ্চতম ভবনের তালিকা করা হয়। তবে মানুষ থাকার জন্য তৈরি সর্বোচ্চ তলাটির উচ্চতা বিবেচনায় নিয়েও উচ্চতম ভবনের তালিকা করা হয়। এ হিসাবে সাংহাই ওয়ার্ল্ড ফাইন্যান্সিয়াল সেন্টার পেছনে ফেলে দেয় তাইপে ১০১ কে।
সর্বোচ্চ উচ্চতার ভিত্তিতে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারকে পেছনে ফেলতে সিয়ার্স টাওয়ারের এন্টেনার উচ্চতা বাড়ানো হয়েছিল। তবে যেকোন মানদন্ডেই বুর্জ খলিফা এখন বিশ্বের উচ্চতম ভবন।
আসছে আরো উচুঁ ভবন - কিংডম টাওয়ার
সৌদি আরবের জেদ্দায় নির্মাণ কাজ চলছে কিংডম টাওয়ার এর।
এটির শুধু প্রারম্ভিক খরচই হলো মার্কিন $ ১.২৩ বিলিয়ন, অর্থাৎ কিনা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। ভবনটি জেদ্দার উত্তর দিকে লোহিত সাগর বরাবর স্থানে অবস্থিত হবে। পরিকল্পনা মোতাবেক কাজটি সম্পন্ন হলে, এটিই হবে বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতম ভবন। ভবনটির প্রাথমিক উচ্চতা ১.৬ কিলোমিটার (১ মাইল) হবে বলে পরিকল্পনা করা হয়; তবে এলাকার ভূতত্ত্বের শক্তি অনুসারে ১.৬ কিলোমিটার ভবন নির্মান সম্ভব হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমান পরিকল্পনানুসারে এটির উচ্চতা হবে ১ কিলোমিটার । এটি বানাচ্ছেন সৌদি আরব নেতা প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল ও রাজা আবদুল্লাহর ভাগ্নে । ২০১৯ এ ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নির্মাণের বছর | ভবনের নাম | ছাদের উচ্চতা | তলার সংখ্যা | সর্বোচ্চ বিন্দুর উচ্চতা |
১৮৭০ | ইক্যুইটেবল লাইফ ভবন, নিউইয়র্ক (১৯১২ সালে এক অগ্নিকান্ডে ধ্বংস হয়) | ৪৩ মিটার | ৮ | -- |
১৮৮৯ | অডিটোরিয়াম ভবন, শিকাগো | ৮২ মিটার | ১৭ | ১০৬ মিটার |
১৮৯০ | নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং (১৯৫৫ সালে ভেঙে ফেলা হয়) | ৯৪ মিটার | ২০ | ১০৬ মিটার |
১৮৯৪ | ম্যানহাটান লাইফ ইন্স্যুরেন্স বিল্ডিং (১৯৬৩ সালে ভেঙে ফেলা হয়) | ১০৬ মিটার | ১৮ | -- |
১৮৯৫ | মিলওয়াকি সিটি হল | ১০৮ মিটার | ১৫ | -- |
১৮৯৯ | পার্ক রো বিল্ডিং | ১১৯ মিটার | ৩০ | -- |
১৯০১ | ফিলাডেলফিয়া সিটি হল | ১৫৫.৮ মিটার | ৯ | ১৬৭ মিটার |
১৯০৮ | সিঙ্গার বিল্ডিং (১৯৬৮ সালে ভেঙে ফেলা হয়) | ১৮৭ মিটার | ৪৭ | -- |
১৯০৯ | মেট লাইফ টাওয়ার, নিউইয়র্ক | ২১৩ মিটার | ৫০ | -- |
১৯১৩ | উলঅর্থ বিল্ডিং | ২৪১ মিটার | ৫৭ | -- |
১৯৩০ | ৪০ ওয়ালস্ট্রিট | -- | ৭০ | ২৮৩ মিটার |
১৯৩০ | ক্রিসলার বিল্ডিং, নিউইয়র্ক | ২৮২.৯ মিটার | ৭৭ | ৩১৯ মিটার |
১৯৩১ | এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, নিউইয়র্ক | ৩৮১ মিটার | ১০২ | ৪৪৩ মিটার |
১৯৭২ | ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, নিউইয়র্ক (২০০১ সালের হামলায় ধ্বংস হয়) | ৪১৭ মিটার | ১১০ | ৫২৬.৩ মিটার |
১৯৭৪ | উইলিস টাওয়ার (সাবেক সিয়ার্স টাওয়ার), শিকাগো | ৪৪২ মিটার | ১০৮ | ৫২৭ মিটার |
১৯৯৮ | পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, মালয়েশিয়া | ৪৫২ মিটার | ৮৮ | -- |
২০০৪ | তাইপে ১০১ | ৪৪৯ মিটার | ১০১ | ৫০৯ মিটার |
২০০৮ | সাংহাই ওয়ার্ল্ড ফাইন্যান্সিয়াল সেন্টার | ৪৮৭ মিটার | ১০১ | ৪৯২ মিটার |
২০১০ | বুর্জ খলিফা, দুবাই | ৮২৮ মিটার | ১৬৩ | ৮২৯.৮ মিটার |
Post a Comment