অদ্ভুতুড়ে 7:22 AM

পুলিশ রাতেই পোলিং এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়েছে।


সকাল নয়টা। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের সামনে একদল তরুণ। সবার বুকে বা গলায় ঝোলানো সাঈদ খোকনের ইলিশ মাছ ও ঘুড়ি মার্কা ব্যাজ। ঘুড়ি ওই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী মুন্সী কামরুজ্জামানের প্রতীক। তাঁদের কেউ দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। কেউ ভোটারদের নম্বর বের করে দিচ্ছেন। এর আগে পথে ক্রাচে ভর দেওয়া এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞেস করি, ভোট দিয়েছেন? সহাস্যে বললেন, ‘ভোট দিইনি। তবে আমার ভোট আমি আব্বাস ভাইকেই দেব। কিন্তু কেন্দ্রে আব্বাস ভাইয়ের সমর্থক কাউকে পেলাম না।’ কেন্দ্রের ভেতরে নারী ভোটারদের লম্বা লাইন। তুলনায় পুরুষ ভোটারের সংখ্যা কম। ইলিশ মাছ ও ঘুড়ি মার্কাধারী তরুণেরা তাঁদের তদারক করছেন। প্রতিটি বুথে পোলিং কর্মকর্তারা ভোটারদের মুড়ি ছিঁড়ে ব্যালট পেপার দিচ্ছেন। সামনের টুলে বসা দুতিনজন পোলিং এজেন্ট। সবাই ইলিশ মাছ ও ঘুড়ি মার্কার সমর্থক। জিজ্ঞেস করলাম, মগ মার্কা বা অন্য প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট কোথায়? পোলিং কর্মকর্তা বললেন, আর কেউ আসেননি। ফেরার পথে গেটে আনসার ভিডিপির জ্যাকেট পরা কয়েকজন অল্পবয়সী ছেলেকে দেখলাম। কারও কারও বয়স ১৫-১৬। গায়ে আনসার ভিডিপি জ্যাকেট থাকলেও তারা আনসার বাহিনীর কেউ নয়। কেবল ভিকারুননিসা নূন স্কুল নয়, ঢাকা দক্ষিণের যে কটি কেন্দ্র ঘুরেছি, সবটাতেই আনসার ভিডিপির জ্যাকেট পরা এই অল্পবয়সী তরুণ-তরুণীদের দেখেছি। এরপর সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাইস্কুলের কেন্দ্রে গিয়ে দেখি ভোটার সংখ্যা খুবই অল্প। পোলিং কর্মকর্তাদের পাশাপাশি উটকো লোকও আছেন। একজন–দুজন করে ভোটার ভোট দিচ্ছেন। এরই মধ্যে একটি বুথে কয়েকজন তরুণ ব্যালট বাক্সে বেশ কিছু ব্যালট গুঁজে দিলেন। পোলিং কর্মকর্তা দেখেও দেখলেন না। বুথ থেকে বেরিয়ে আসতেই আবু জুবায়ের মো. মিরাতিল্লাহ নামে একজন কাউন্সিলর প্রার্থী, যাঁর মার্কা করাত, আমাদের দেখে ছুটে এলেন। বললেন, ‘আপনাদের কাছে প্রতিকার চাই। আমি কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েও ভোট দিতে পারিনি। সকাল সাড়ে আটটায় কেন্দ্রে এসে দেখি, আমার ভোটটি দেওয়া হয়ে গেছে।’ তিনি প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগও করেছেন। এ রকম আরও কয়েকজন অভিযোগ করলেন, তাঁরা ভোট দিতে পারেননি। ওখানেই আলাপ হয় ফেমার পর্যবেক্ষণ দলের সদস্য শাহজাহান ছিদ্দিকি ও নাজমা চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁরা এর আগে ইস্কাটন এলাকার কয়েকটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন দেখলেন? বললেন, তথৈবচ। রাস্তা পার হতেই শান্তিনগরের একটি ভোটকেন্দ্র। ভেতরে ঢুকে দেখি থমথমে অবস্থা। আমাদের ঢুকতে দেখে কয়েকজন তরুণ বাঁকা চোখে তাকালেন। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা হেসে বললেন, ভোট শান্তিপূর্ণভাবেই হচ্ছে। কোনো গোলযোগ নেই। এর মধ্যে দক্ষিণে সিপিবি-বাসদের সমর্থক মেয়র প্রার্থী বজলুর রশীদ ও কাউন্সিলর প্রার্থী শম্পা বসু কয়েকজন সমর্থককে নিয়ে কেন্দ্রের ভেতরে আসতেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। মেয়র প্রার্থীর সমর্থকেরা জানান, সকালে এই এলাকার প্রতিটি কেন্দ্রে তাঁরা পোলিং এজেন্ট পাঠালেও তাঁদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এঁদের মধ্যে ছিলেন পারভীন বেগম, শাম্মী আরা সাথি, মো. ইসয়াসিন। আমাদের দেখে ইলিশ মাছের সমর্থক একজন তরুণ এসে বললেন, কেন্দ্রের ভেতরে সাংবাদিকদের প্রবেশ করার নিয়ম নেই। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো আপনি কোন নিয়মে কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকেছেন। এ নিয়ে কিছুটা বাগ্বিতণ্ডা দেখা দিলে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ওই তরুণসহ সবাইকে বাইরে যেতে বললেন। কিন্তু বজলুর রশীদের সমর্থকেরা জানতে চান, কেন তাঁদের পোলিং এজেন্টদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এরপর দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা এখানে গোলযোগ করবেন না বলে সবাইকে কেন্দ্রের বাইরে যেতে বলেন। মেয়র প্রার্থীর সমর্থক একজন নারী কর্মী, যিনি নিজে তৈরি পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, ভিকারুননিসায় নারী ভোটারদের লম্বা লাইনের রহস্যভেদ করলেন। বললেন, রাতে বাস ভর্তি করে নারী শ্রমিকদের বাড্ডা এলাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। পরে আমরা মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের বাড়ির পাশের কেন্দ্র শাহজাহানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে যাই। সেখানকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সব প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট আছেন। তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম, কেমন ভোট হচ্ছে? বললেন, ভালো। অনেকগুলো বুথে বিভক্ত এই কেন্দ্রে ভোটের হারও সন্তোষজনক। বেলা ১১টা নাগাদ ৩০ ভাগ ভোট হয়ে গেছে। সেখানেই আলাপ হয় প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সৈয়দ লিয়াকত হোসেনের সঙ্গে। তিনি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। কেমন ভোট হচ্ছে জিজ্ঞেস করলে বললেন, খেলতে নেমে মাঠে সক্রিয় না থাকলে যা হওয়ার তা–ই হচ্ছে। ইতিমধ্যে খবর এল বিএনপি চট্টগ্রামে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। সেখানে উপস্থিত আরেকজন বললেন, খালেদা জিয়া নীরব ভোট বিপ্লবের ডাক দিয়ে এখন নীরবে প্রস্থান করছেন। মাঝখানে দলের কর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। শাহজাহানপুর থেকে আরও কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাই। ইতিমধ্যে বিএনপি ঢাকায়ও ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বললেন, এটা কোনো নির্বাচনই নয়। সরকার ও নির্বাচন কমিশন মিলে সিটি নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে। তাঁর পাশে ছিলেন দুই মেয়র প্রার্থী উত্তরের তাবিথ আউয়াল ও দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস। বিএনপি অফিসে নেতা-কর্মীদের চেয়ে সাংবাদিকদের ভিড়ই বেশি। নিচের তলায় নামতে দলের দুই নারী কর্মীকে দেখলাম বেজার মুখে বসে আছেন। তাঁদের জিজ্ঞেস করি, আপনারা পোলিং এজেন্ট দিলেন না কেন? মাঠ ছেড়ে দিলেন কেন? বললেন, পুলিশ রাতেই পোলিং এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়েছে। তাদের বাবা-মাকে শাসিয়েছে। জীবনের মায়া সবার আছে। তাঁরা বললেন, আপনারা যা দেখলেন, তাই লিখুন। নিচে নেমে এক ট্যাক্সিচালককে জিজ্ঞেস করলাম, ওপরে কী হচ্ছে জানেন? বললেন, ‘ম্যাডাম এসেছেন।’ না, খালেদা জিয়া তো আসেননি। তিনি বললেন, ‘আমি খালেদা জিয়ার কথা বলিনি। বলেছি, আফরোজা ম্যাডামের কথা।’ আসলে গত তিন সপ্তাহে বিএনপির যদি কোনো অর্জন থেকে থাকে একজন গৃহবধূকে নেত্রীর আসনে নিয়ে আসা। দক্ষিণের বিএনপির কর্মীদের কাছে আফরোজা আব্বাসই ম্যাডাম।

Post a Comment

'; (function() { var dsq = document.createElement('script'); dsq.type = 'text/javascript'; dsq.async = true; dsq.src = '//' + disqus_shortname + '.disqus.com/embed.js'; (document.getElementsByTagName('head')[0] || document.getElementsByTagName('body')[0]).appendChild(dsq); })();
Powered by Blogger.